সর্বকালের সেরা “ইন্টারস্টেলার” সিনেমা রিভিউঃ পর্ব – ১

প্রথমবার যখন ইন্টারস্টেলার দেখতে বসেছিলাম তখন আমার ধারণা ছিলো আমি একটা মাস্টারপিস দেখতে যাচ্ছি কিন্তু মুভি শেষ করার পরে আমি বুঝলাম এটা মাস্টারপিস ছিলোনা , এটা ছিলো ইউনিক এবং এপিক ! ইন্টারস্টেলার তার দর্শকদের এমন এক অনুভুতি দেয় যা শুধু ইন্টারস্টেলারই দিতে পারবে । দর্শক একবার মুভিটা দেখতে শুরু করলে হারিয়ে যাবেন এর জগতে । পুরোটা সময় এক অন্যরকম ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাবেন দর্শকরা ।

কেন ইন্টারস্টেলারের এত জনপ্রিয়তা

এর উত্তরে আমি দুটো বিষয়ের কথা বলবো । সেই বিষয় দুটো হলো ইন্টারস্টেলারের গল্প আর তার সাউন্ডট্র্যাক । ইন্টারস্টেলার মুভির যে ইউনিক ফিলিংস পাওয়া যায় তার পেছনে এই দুটো বিষয় মূল কারিগর । সাইন্স আর ইমোশনের যে ব্যালেন্স করা হয়েছে এই মুভিতে তা জাস্ট অসাধারণ । টাইম ডিলেশন , ব্ল্যাক হোল , টাইম টেরাস, মাল্টিভার্সের মতো জটিল বিষয়গুলো এতটা রিয়েলিস্টিক ভাবে কখনও কোন মুভিতে দেখানো হয়নি ।

গল্পের প্রতিটি স্তরে দর্শকরা যখন অ্যাস্ট্রনমির নতুন নতুন সাবজেক্ট এক্সপ্লোর করতে থাকবেন তখন যেমন এক ফ্যান্টাসি আর অ্যাডভেঞ্চারাস ফিল পাবেন তেমনই গল্পের শুরু থেকে বিল্ডআপ করা মেইন ক্যারেক্টারগুলোর ইমোশনাল বন্ডিং পুরো মুভি জুড়ে দর্শককে ইমোশনালি কানেক্ট করে রাখবে । সবকিছুর ওপরে ভালোবাসা আর সম্পর্কের যে প্রভাব এখানে দেখানো হয়েছে তা অতুলনীয়  কিন্ত এইসবকিছু তো এই মুভির ৫০% ফিল দেবে , বাকি ৫০% হলো এর সাউন্ডট্র্যাক। সাউন্ডট্র্যাক একটা মুভিতে কতোটা ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে তার সেরা উদাহরণ ইন্টারস্টেলার । স্পেস এর যে গ্র্যান্ডিওর, যে মিস্ট্রি সেটা যদি মিউজিকে প্রকাশ করা যায় তবে তা হলো ইন্টারস্টেলারের বিজিএম ।

একই সাথে অ্যাডভেঞ্চার এবং ইমোশনের যে ফিল দেয় এই মুভির সাউন্ডট্র্যাক তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না । ইমোশনাল সিকোয়েন্সগুলতে দর্শক ডিপ্রেসিভ ফিলিংস পাবেন এই মুভির সাউন্ডট্র্যাকের জন্য। এরকম ইমপ্যাক্টফুল সাউন্ডট্র্যাক এর জন্য হেনস জিমারকে অবশ্যই লিভিং লেজেন্ড বলা যায় । সব মিলিয়ে নির্মাতার ক্রিস্টোফার নোলান যে কোন লেভেলের নির্মাতা আর হেন্স জিমার কোন লেভেলের কম্পোজার তার প্রমাণ ইন্টারস্টেলার। দুজনকেই অসংখ্য ধন্যবাদ এই ইউনিক ক্রিয়েশনের জন্য ।

কেন এটাকে সর্বকালের সেরা সাইন্স ফিকশন মুভি বললেও ভুল হবেনা ?

এক ‘ইন্টারস্টেলার’ মুভি দিয়ে যদি আমি ক্রিস্টোফার নোলানকে বর্ণনা করি, তাহলে এটি দিয়েই সেরা পরিচালকদের কাতারে চলে গেছেন। আহ, ভবিষ্যৎ মানবজাতিকে নিয়ে কি ভাবনা তার!
ইন্টারস্টেলারে অনবদ্য এক গল্প ফাঁদলেন পৃথিবীকে বাঁচাবেন বলে। এরপর বলতে হয় আরেক ফ্যান্টাসি ‘ইনসেপশন’ নিয়ে। কিংবদন্তি অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও লীড রোলে। লিও-নোলান কম্বো জুটিই যথেষ্ট মানুষের সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ার জন্য। তন্মধ্যে ইনসেপশন স্বপ্ন গল্প। এ যেনো সোনায় সোহাগা।

আসলে ক্রিস্টোফার নোলান মানুষের মগজ নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন। ইনসেপশনে স্বপ্নের কারসাজির পর ‘টেনেট’ মুভিতে বুদ্ধির মারপ্যাচ ভাবায় কয়েকবার। কিছুক্ষণ পর মস্তিক্স ছেড়ে দেয় আপনাআপনি, থাক ভেবে আর লাভ নেই।

ক্রিস্টোফার নোলান আরেকখানা ইতিহাস করে গিয়েছেন ‘ডার্ক নাইট ট্রিয়োলজি’তে। ব্যাটম্যান বিগিনসের পর ২০০৮ সালে আসে ‘দ্য ডার্ক নাইট’। ৯ আইএমডেবি রেটিং নিয়ে সুপারহিরো জনরার অন্যতম সেরা মুভি হয়ে থাকবে। সুপারভিলেন জোকার ও তার ফিল্ম কাঁপানো ‘Why So Serious’ এর মত ডায়লগ আবিষ্কারে যথেষ্ট প্রশংসার দাবিদার ক্রিস্টোফার নোলান। এরপর Memento, Following, Insomnia, The Prestige, Dumkrik মুভি গুলোও দুর্দান্ত। তার আপকামিং মুভি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টাইমলাইনে ফাদার অফ এটম বম্ব খ্যাত স্যার রবার্ট ওপেনহাইমারের বায়োগ্রাফিক্যাল থ্রিলার মুভিটি ২০২৩ এর জুনে রিলিজ হওয়ার কথা রয়েছে।

এই মুভির কাস্টিংয়ে রয়েছেন রবার্ট ডাওনি জুনিয়র, ম্যাট ডেমন ও কিলিয়ান মার্ফির মত অভিনেতারা। এই মুভিটিও রীতিমতো আগুন নিয়েই আসছে!

‘ক্রিস্টোফার নোলান’ এর মুভিগুলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- একবার না বুঝিলে দেখো শতবার। শতবার না দেখলেও তার বেশীরভাগ মুভিই একাধিকবার দেখার প্রয়োজন পরে।

ইন্টারস্টেলার মুভিতে যা যা দেখানো হয়েছে তার প্রায় ৯৫% বৈজ্ঞানিক ভাবে এবং থিওরিটিকাল ভাবে প্রুভ করা। বিশেষ করে সাইন্স এর স্টুডেন্টস দের জন্য এটি একটি ভালো লেসন, যা টাইম ট্রাভেলিং, থিওরি অব রিলেটিভিটি, ডাইমেনশন, প্যারালাল ইউনিভার্স, সিংগুলারিটি এবং মহাকাশ এর অন্যান্য বিষয় নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান দিতে সক্ষম। মুভিটি যদি কেউ পুরোপুরি বুঝতে পারে এবং হিসেব গুলো মিলাতে পারে, তবে অবশ্যই এটি আনন্দ লাগবে।

ইন্টারস্টেলার স্পয়লার এলার্টঃ

পৃথিবী ময়লা আবর্জনাপূর্ণ। প্রাকৃতিক দূর্যোগ,খরা,বালুঝড় ইত্যাদি ঘিরে ফেলেছে পৃথিবী কে.. মানবজাতির অস্ত্বিত্ত হুমকির মুখে। শুধু একটি পথ ই খোলা আছে এই হুমকির মুখ থেকে মানব জাতিকে রক্ষা করার… ইন্টারস্টেলার ট্রাভেল। অর্থাৎ সৌরজগৎ ভ্রমন। নতুন একটি ওয়ার্মহোল আবিষ্কৃত হয়েছে,যার মধ্য দিয়ে মানুষ হয়তো নতুন কোনো গ্রহের সন্ধান পেতে পারে যেখানে মানুষ নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে পারবে,আবার বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবে ফসল ফলাতে পারবে।

পৃথিবী ধ্বংসের মুখে। এই পৃথিবীতে ইঞ্জিনিয়ার এর কোনো মূল্য নেই, মূল্য আছে কৃষক এর, যে কিনা এক আনি ফসল ফলাতে পারবে.. বিষাক্ত এই পৃথিবীতে ধুলিঝর গ্রাস করে ফেলছে সব ফসল, দুর্ভিক্ষ হানা দিচ্ছে পৃথিবীতে.. এমন ই এক বিষাক্ত পৃথিবীতে বাস করে কুপার, তার একমাত্র ১০ বছরের মেয়ে মার্ফ এবং তার ছেলে টম কে নিয়ে। তাদের সাথে আছে কুপার এর ফাদার ইন ল।

একদিন সকালে মার্ফ ঘুম থেকে উঠে দেখলা তার বুক শেল্ফ এর বইগুলো মাটিতে পরে আছে। সব বই না, কিছু কিছু বই.. কেউ যেনো সতর্ক ভাবে বেছে বেছে তার সেল্ফ থেকে কয়েকটা বই ফেলে দিয়েছে.. মার্ফ বই গুলো উঠিয়ে রাখলো… ভুলে গেলো সেদিনের কথা। পরের দিন সকালে উঠে দেখে এক ই কান্ড, সেল্ফের বই গুলো মাটিতে পরে আছে। সে বুঝতে পারছে না ঘটনা কি। মার্ফ কুপার কে ডাকলো,ডেকে বলল সব কিছু.. কুপার বিশ্বাস করলো না,বলল হয়তো বা বাতাসে পড়ে গেছে বই।

কিন্তু ঘটনা এখানেই থামলো না। একদিন মারাত্মক ধুলিঝর এ তাদের সারাঘর ধুলোয় ভরে গেলো। মার্ফ এবং কুপার মার্ফ এর রুমে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলা রুমের এক কোনায় বালু গুলো আলাদা আলাদা গুচ্ছো আকারে পরছে, যেনো কেউ বালু গুলো কোথায় পড়বে তা সুবিন্যস্ত ভাবে সাজিয়ে রেখেছে.. মার্ফ কুপার কে বিজয়ীর ভংগিতে বলল, দেখলেতো? বললাম না আমার রুমে ভূত আছে?

কুপার একটা ছোট কয়েন এনে সুবিন্যস্ত বালুর দিকে লক্ষ্য করে সোজা ছুড়ে মারলো, সে দেখলো যে অংশ টাতে বালু নেই সেদিক থেকে কয়েন টা চুম্বক এর মত সরে গিয়ে যেদিকে বালু পরছে সেদিকে গিয়ে পরলো..

কুপার হাসি দিয়ে বলল “Its not a ghost, its gravity

কেউ যেনো সুকৌশলে মার্ফ এর রুমের অভিকর্ষজ ত্বরন কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলো। কুপার এবার এই বালুরেখার অর্থ বুঝতে বসলো, কিছুক্ষন লক্ষ্য করার পরে সে দেখতে পেলো বালুগুলো বাইনারী সংখ্যা অনুযায়ী পরছে। কুপার একটা মানচিত্র নিয়ে এর অর্থ বের করতে বসলো, সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো বালুরেখাটি কোন একটি নির্দিষ্ট অক্ষরেখা & দ্রাঘিমারেখা নির্দেশ করছে.. কুপার দেরী না করে গাড়ি নিয়ে বালুরেখার গন্তব্যে রওনা হলো। অর্ধেক পথ গিয়ে সে দেখলো গাড়ির সিট এর নিচে মার্ফ লুকিয়ে আছে, তার আগ্রহের সীমা নেই। মার্ফ তার বাবার মত বাইনারী কোড এর অর্থ জানতে চায়..

গন্তব্যে পৌছে কুপার একটি নাসা(NASA) বেস দেখতে পেলো,যারা প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন গ্রহ খুজতে যাওয়ার জন্য এবং কুপারের পাইলট পেশনে যথেষ্ট দক্ষতা থাকায় কুপার কে তারা চাচ্ছে তাদের রকেট এর পাইলট হিসেবে রওনা দেয়ার জন্য। কুপার এর দিকে তারা ঠেলে দিলো বিশাল এক চয়েস, হয় সে পৃথিবীতে তে থাকবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্মের ধীর মৃত্যু দেখবে, অথবা সে তার পরিবার আর কখনো না দেখার সম্ভাবনা নিয়ে সুইসাইড মিশনে পাড়ি জমাবে? এমন এক ওয়ার্মহোল দিয়ে প্রবেশ করবে তারা যেখানে আগে কেউ যায়নি, কি আছে সেখানে? কুপার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রেস্কিউ মিশন এ যাওয়ার। পরবর্তী পর্বঃ এখানে

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *