“দুই দুয়ারী” হুমায়ুন আহমেদের এক অদ্ভুত উপন্যাস

পৃথিবী বিচিত্র তবে তার চেয়েও প্রকট এর রহস্যময়তা। জীবনের পাঠ জুড়ে চলতে রহস্যের অলীক খেলা।সেই খেলায় কেউ টিকে যায়,কারো বা ছন্দপতন হয়।আমরা কেউ না কেউ সেই রহস্যের খেলার সাথে জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে। সেখানে আমাদের দেখা হয় বহু বিচিত্র মানুষদের সাথে।এরা আমাদের মতোই কিন্তু চিন্তা চেতনায় অন্য এক ছাঁচে গড়া।

হুমায়ূন আহমেদ এদের নাম দিয়েছেন রহস্য মানব। অধিকাংশ ক্ষেত্রে‌ই এই রহস্য মানবের কোন নাম থাকে না।এরা হুট করে আবির্ভূত হয় আবার হারিয়েও যায়। কিন্তু হারিয়ে যাবার আগে সবকিছু স্বাভাবিক করে দিয়ে যায়। না কোন ম্যাজিকের জাদুতে নয়,মায়াতেও নয়। এরা সবকিছু করে আপন চিন্তাশক্তি দিয়ে। সাধারণের মাঝে অসাধারণ তারা।

এভাবেই তরুদের বাসায় নাটকীয়ভাবে আগমন এক রহস্য মানবের। লোকটা তার নাম জানে না কিন্তু গিটার হাতে সারাক্ষণ গান গায়,বৃষ্টিতে কফি খায়,সাদা ক্যাপ পরে থাকে।এই বিচিত্রতা চোখে পড়ে তরুর পরিবারের চোখে।তারা বেশিদিন এই রহস্যমানবকে রাখতে চায় না। কিন্তু রহস্য মানব দার্শনিক যুক্তির খোড়া দিয়ে মুহুর্তেই সব কিছু ঠিক করে দেয়।

হুমায়ূন আহমেদ এদের নাম দিয়েছেন রহস্য মানব

রহস্য মানব বলে, জগৎটা ম্যাজিকের…We must believe in magic রহস্য মানবের সরল যুক্তিগুলো মুহুর্তেই একটি অগোছালো পরিবারকে নতুন জীবন দেয়। ফুপিকে পাগল থেকে স্বাভাবিক করে তোলে, মোবারকের সাথে কুদরতি বেগমের বিয়ে অন্যদিকে তরুর মনে নতুনভাবে ভালোবাসার উদ্রেক করে।সেই ভালোবাসার টানে তরু ছুটে যায় মৃত্যুপথযাত্রী প্রেমিক শফিকের কাছে।

  • মুভি রিভিউ
  • দুই দুয়ারী
  • Imdb: 7.8/10
  • পরিচালনায়: হুমায়ূন আহমেদ
  • অভিনয়ে: রিয়াজ,মেহের আফরোজ শাওন,মাহফুজ আহমেদ,ডা.এজাজুল ইসলাম প্রমুখ।
  • মুক্তি: ৭ ডিসেম্বর,২০০০

রহস্য মানব বেজায় অদ্ভুত কিন্তু যুক্তিগুলো অতি স্বাভাবিক।যুক্তি না বলে সুন্দরভাবে বলা চলে সরল স্বীকারোক্তি।মানুষ বিচিত্রতার দাস।এই বিচিত্রতাই মানুষকে সুন্দর করে তোলে।যেমনটা দেখা যায় যখন মোবারক মিয়াকে রহস্য মানব বলে,দুই দিন গাছ হয়ে থাকতে।পরামর্শগুলো অদ্ভুত কিন্তু জীবনমুখী।

মুভির সবচেয়ে চমৎকার জায়গাটি হচ্ছে এর পরিচ্ছন্ন কনসেপ্ট। মুভির কাহিনী আমাদের আর দশটা সাধারণ জীবনের। এখানে বিভিন্ন সমস্যা আছে যার সমাধান আমরা নিজেরাই একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বের করে ফেলতে পারি।এতো গোছালো সংলাপ,পরিচ্ছন্ন কাহিনী কেবল হুমায়ূন আহমেদের পক্ষে‌ই সম্ভব।

মুভির প্রতিটি সংলাপ ও অভিনয় মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।বিশেষ করে রহস্য মানবের চরিত্রে রিয়াজের অভিনয় ভুলবার নয়। হুমায়ূন আহমেদ রিয়াজকে তাঁর মুভি নাটকে এতো সুন্দর করে কাজে লাগিয়েছেন ভাবনাতীত।সেই সাথে শাওন কিংবা মাহফুজের বিরহ প্রেমের কাহিনী গল্পে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।

গল্পে অপ্রধান হলেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল মোবারক মিয়া।তার বোকামি আর চতুরতা গল্পে আলাদা রস সৃষ্টি করে।বিশেষত রহস্য মানব আর মোবারকের মধ্যকার কথোপকথন উপভোগ করার মতো।মুভির প্রতিটা চরিত্র নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে ধারণ করেছে।তাদের সংলাপগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়।অতি স্বাভাবিক কিন্তু পরিস্থিতি যেন সংলাপগুলোকে মায়াময় করে তোলে।এমন‌ই একটি সংলাপ আছে বর্ষার বৃষ্টিতে বন্দি ফুপি যখন তরুকে অনুরোধ করে, একটু বৃষ্টির পানি আনতো। গালে মাখবো।

ঐ মুহুর্তটা আলাদা একটা সকরুণ আবহ তৈরি করে

মুভির আরেকটি চমৎকার কনসেপ্ট হচ্ছে প্রকৃতি।হুমায়ূন আহমেদ শহুরে আর গ্রামীণ প্রকৃতিকে সাত পাকে কীভাবে বেঁধেছেন সেটাই ভাবনাতীত।শহুরে প্রকৃতির কনসেপ্ট দেখাতে গিয়ে রহস্য মানবের বৃষ্টিতে ভিজে কফি পানের চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন আর শাওন আর মাহফুজ গ্রামে ঘুরতে যাওয়ার মাঝে একটা গ্রামীণ আবহের তৈরি হয়।

মুভিতে আলাদা মাত্রা দিয়েছে এর চমৎকার গানগুলো।বিশেষ করে বলতে হয় আগুনের কন্ঠে “মাথায় পড়েছি সাদা ক্যাপ” গানটার কথা। এখানেও প্রকৃতির বর্ণণার এক ঝলক দেখি। সর্বোপরি বলতে চাই এই মুভি হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী নির্মাণ। যদিও মুভি বানানো হয়েছে দুই দুয়ারী ব‌ইয়ের কনসেপ্ট থেকে তবুও ব‌ই থেকে মুভির প্লট অনেকটাই আলাদা আর চরিত্রবিন্যাস অভিন্ন নয়।

আমার মতে মুভির গল্প স্বয়ং লেখকের উপন্যাসকেও ছাড়িয়ে গেছে।ইমোশনকে টাচ করেছে। জীবনে আবশ্যিক কিছু মুভির দেখার তালিকায় রাখতে পারেন হুমায়ূন আহমেদের কালজয়ী “দুই দুয়ারী” মুভিকে।

রিয়াজের ক্যারিয়ার গ্রাফ বেশ সমৃদ্ধ। একদিকে তিনি যেমন টানা হার্ডকোর কমার্শিয়াল সিনেমা করেছেন, তেমনই নিয়মিতভাবে তিনি অভিনয় করেছেন সাহিত্যনির্ভর সিনেমাতেও। হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় অভিনেতাদের একজন ছিলেন তিনি, একারণে হুমায়ূনের সঙ্গে কাজ করবেন বলেই বড় পর্দায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার সময়টাতেও ছোটপর্দায় অভিনয় করেছেন।

কিছু অভিনেতা থাকেন, ডিরেক্টর্স আর্টিস্ট। নির্মাতার হাতে নিজেকে সঁপে দেন। গুণী নির্মাতারা তাদের ভেতর থেকে সেরা অভিনয়টা বের করে আনতে পারেন। রিয়াজের বেলায় সেরকমটাই হয়েছিল। তিনি কাজ করেছেন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে, চাষী নজরুল ইসলাম, সুচন্দা, তৌকির আহমেদের মতো নির্মাতাদের সঙ্গে।

শ্যামল ছায়া, হাজার বছর ধরে, দারুচিনি দ্বীপ

তার ক্যারিয়ারে আছে দুই দুয়ারী, শ্যামল ছায়া, হাজার বছর ধরে, দারুচিনি দ্বীপ, মেঘের পরে মেঘ বা শাস্তির মতো দারুণ সব সিনেমা। ক্যারিয়ারের পড়ন্তবেলায় যেগুলোর দিকে তাকিয়ে একজন অভিনেতা গর্ব করতে পারেন, বলার মতো কিছু অর্জন তার নামের পাশে আছে বলে!

ক্যারিয়ারের পিক টাইমে একই সাথে কমার্শিয়াল এবং অফ-ট্র‍্যাকের সিনেমা যুগপৎভাবে চালিয়ে যাওয়াটা বেশ বিরল নিদর্শন। বিশেষ করে আমাদের দেশে, যেখানে গল্পনির্ভর সিনেমাকে ‘নাটক’ বা ‘টেলিফিল্ম’ এর খেতাব দেয়া হয় হরহামেশাই। সেখানেই দাঁড়িয়ে রিয়াজ বিরুদ্ধ স্রোতে ক্যারিয়ারের তরী বেয়েছিলেন। এই কাজগুলো করেছেন বলেই তার ক্যারিয়ারটা সমৃদ্ধ হয়েছে।

কমার্শিয়াল সিনেমা তাকে খ্যাতি দিয়েছে, বিত্ত দিয়েছে, দিয়েছে জনপ্রিয়তা। কিন্তু একটা ‘দুই দুয়ারী’, ‘হাজার বছর ধরে’ বা ‘শ্যামল ছায়া’ তাকে অভিনেতা হিসেবে যে তৃপ্তি দিয়েছে, সেটা দিতে পারেনি অন্য কোন সিনেমা। যতই এখন তাকে নিয়ে ট্রল হোক, ঠাট্টা করা হোক- রিয়াজের এই অর্জনগুলো তো মুছে ফেলা যাবে না।

“দুই দুয়ারী” হুমায়ুন আহমেদের এক অদ্ভুত উপন্যাস

“দুই দুয়ারী”
পরিচালকঃ হুমায়ুন আহমেদ
রচয়িতাঃ হুমায়ুন আহমেদ
অভিনয়েঃ রিয়াজ,মাহফুজ,মাসুদ আলী খান,নাসিমা খান,শাবনাম পারভীন,আমিরুল হক চৌধুরী,এজাজুল ইসলাম,শামীমা নাজনীন, আরো অনেকে
ব্যাপ্তিকালঃ ১৪০ মিনিট
মুক্তিসালঃ ২০০০ইং
ব্যক্তিগত মতামতঃ ৮/১০

“দুই দুয়ারী” হুমায়ুন আহমেদের এক অদ্ভুত উপন্যাস, এই উপন্যাস পরে অবাক হয়নি এমন মানুষ কম আছে। জনাব হুমায়ুন আহমেদ তাঁর ধারার বাহিরে গল্পটা নির্মাণ করেছিলেন আমার যা মনে হয়। গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এই উপন্যাসের বইটার কভার ছিলো দেখার মতো, একটু ভিন্ন ধারার যদিও।

সিনেমার সাথে গল্পের কিছু কিছু জিনিষ মিলিয়ে পাবেন না, তাই ছবি দেখার সময় উপন্যাস মাথা থেকে বের করে ফ্রিজে রেখে দিবেন যাতে উপন্যাসের অংশটা ভুলে না যান। ও হ্যা আরেকটা কথা এই সিনেমাটি তখন তিনটি ক্যাটাগরিতে পেয়েছিলো দেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সম্মান “জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার”।

এই সিনেমায় সকলের অভিনয় একটু ভিন্ন ধারার তবে “শ্রাবণ মেঘের দিনে” কম স্ক্রিণ পাওয়া “মাহফুজ আহমেদ” এখানে যা অভিনয় করেছে তা আসলেই প্রশংসনীয়, জাত অভিনেতা বলে কথা। অন্যদিকে রিয়াজ তো দারুণ, তখন তাঁর নিজস্ব জনপ্রিয়তা আকাশ চুম্বি। তো চলুন অভিনয় নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।

অভিনয় সংক্ষেপ

শামীমা নাজনীনঃ উনি আমার অনেক পছন্দের অভিনেত্রী। প্রতিটা চরিত্রেই সে সব সময় ভালো করে, আমি আজ অবধি তার বাজে অভিনয় আমার দেখা হয় নি। বুয়া থেকে শুরু করে অফিসের এমডি চরিত্রে সে সাবলীল। এখানে সে একজন বদ্ধ উন্মাদের চরিত্রে অভিনয় করেন। আমার মনে হয় তাকে ডায়লগ প্রদানের মাষ্টারনি উপাধি দেওয়া উচিৎ। সে যে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছেন তা বোঝার কোনো অবকাশই পাবেন না

মাহফুজ আহমেদঃ সাদা-মাটা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মাহফুজ সাহেবের দারুণ সুনাম রয়েছে। আমার মতে এই সিনেমার প্রাণ ভোম্রা মাহফুজ আহমেদ। তাঁর সাবলীল অভিনয়ের জোরে আপনাকে দেখতে হবে দারুণ এই সিনেমাটি। অন্যদিকে “শাওনের” সাথে মাহফুজের রসায়নটা আমার কাছে দারুণ লেগেছে

রিয়াজঃ আমার চোখে দেখা ছোট এবং বড় পর্দার সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা হলেন “রিয়াজ আহমেদ সিদ্দিক”। তাঁর রুচীকে আমি সম্মান জানাই সব সময়। আজগুবী গল্পে তার পদচারনা খুবই কম অন্যদের তুলনা, খুঁজে পাওয়াই কষ্ট হবে আজে-বাজে সিনেমায় কাজ করার সংখ্যাটা। “অদ্ভুত” শব্দটার দারুণ ব্যবহার করেছেন রিয়াজ কে দিয়ে হুমায়ুন স্যার।

গল্পের চরিত্রের অদ্ভুদের মাত্রা এখানেও দারুণ ভাবে পাওয়া যাবে যদিও উপন্যাসে বেশি মজা লাগে। এককথায় অভিনেতা নির্বাচনে একশ তে একশ পাবেন হুমায়ুন স্যার। সুন্দর সাবলীল অভিনয়ের জন্য সে বছর রিয়াজ পায় দেশের সবচেয়ে সম্মানের পুরষ্কার “জাতীয় চলচ্চিত্র” পুরস্কার যা আসলেই তাঁর প্রাপ্য ছিলো।

কাহিনীসংক্ষেপঃ শাল বনের ঠিক মাঝ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো এক যুবক! অদ্ভুত ব্যাপার হলো গাড়ি আসতে দেখেও সরে না গিয়ে সে একবারে সামনে চলে আসে! মারাত্মক সংঘর্ষ হবার দারুণ সম্ভবনা থাকলেও সে যাত্রায় আর হলো না! গাড়ির মালিক ভদ্রলোক নেমে এসে আহত অবস্থায় তুলে নেন ছেলেটিকে। ছেলেটির নাম জানতে চাইলে বলে মনে পড়ছে না, ঠিকানা জানতে চাইলে বলে ভুলে গেছি! অবাক হয় সবাই! কেননা আসলে এই ঘটনার পরে বেচে থাকারই কথা ছিলো না তার!

কিন্তু সে বেচে আছে আর বলছে এমন সব অদ্ভুত কথা! তো ভদ্রলোক অদ্ভুত মানব কে বাসায় নিয়ে যায় আর গল্পের নড়াচড়া এখান থেকেই শুরু! বেশ টানটান উত্তেজনাই পাবেন ফিল্মটি দেখার সময়। যারা দেখেন নি দেখে নিবেন খুব ভালো লাগবে আশা করছি, এবং এটাই আশা করছি খুব কম মানুষই পাবো যারা এই সিনেমা দেখে নাই। তো আর দেরি কেনো এখনি বসে পরেন অদ্ভুত গল্প “দুই দুয়ারী” দেখতে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *