২০২২ সালের অন্যতম সেরা সিনেমা “দামাল” এর রিভিউ

আমার মতে,দামাল ২০২২ সালের অন্যতম সেরা সিনেমার তকমা পাবে।আমাদের দেশে স্পোর্টস ড্রামা ভিত্তিক সিনেমা খুবই কম হয়েছে। তবে দামাল এই জনরায় বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সেরা ও রায়হান রাফি নির্মাণকৃত আগের কাজগুলোর থেকে উপরে থাকবে।

গল্পটা আমাদের দেশের বর্তমান সময়ের নারী ফুটবলারদের ভেঙে যাওয়া মনোবল আর ১৯৭১ সালের দামাল ছেলেদের চেতনার আর আত্মত্যাগের উত্থান নিয়ে।নারী ফুটবলার “স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিমের” গল্প বলছেন এক ভদ্র লোক।

মেইন লিডদের মধ্যে কেউ অসাধারণ ছিলো না কিন্তু তারা ভালো করেছেন তাদের চরিত্রে একসেপ্ট মুন্না চরিত্রে রাজ বেশি ভালো ছিলেন।জেদী দুর্জয় চরিত্রে সিয়াম ভালো করেছেন তবে সমস্যা সেই এক্সপ্রেশন আর লাউড ডায়লগ ডেলিভারি তে। সিয়াম এরকম জেদী কেরে charecter আগেও করেছেন।এখানেও সিয়ামের দুর্জয় চরিত্রটি বেশি ফোকাসে ছিলো। রাজের মুন্না চরিত্রটা পরাণ এর রোমান থেকে একেবারে ভিন্ন ছিলো।

তবে সিয়াম আর রাজের ডেডিকেশন প্রশংসনীয়।মিমের হাসনা চরিত্রটি ভালো লেগেছে। শেষে মীমের কোপের সিনটা জাস্ট🔥।সুমি শুধুই সিয়ামের শোপিজ নায়িকা।মেইন লিডদের থেকে ইন্তেখাব দিনার, সুমিত,রাশেদ মামুন অপু, সায়েদ বাবু, মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বেশি ভালো করছিলেন। নারী ফুটবলারদের অভিনয় মোটামুটি।তবে তাদের সিনেমায় গুরুত্ব রয়েছে।

রাজ – মিম জুটির রসায়ন ভালো ছিলো। সিয়াম সুমি জুটির মধ্যে এই জিনিসটি মিসিং।তাদের কোনো রসায়ন আমার চোখে পড়েনি। “দামাল দামাল” গানটা সিনেমা হলে শুনার সময় গুজবাম্প হয়েছে।মমতাজের ঘুঁরঘুঁর পোঁকা গানটা ভালো ছিল।

দামাল এর পজিটিভ দিক

সিনেমার চিত্রনাট্য চমৎকার। সিনেমায় চরিত্রগুলোর বিল্ডআপ এর সাথে গল্প সুন্দর ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল।সিনেমার স্ক্রিনপ্লে গোছানো ছিলো।দ্বিতীয় হাফে কিছু গুজবাম্প মোমেন্ট সিন তৈরি করা (দুর্জয়ের ফ্রি কিক আর মুন্নার বাই সাইকেল কিক) এবং সুন্দর একটি মেসেজের মাধ্যমে সমাপ্তি [ক্লাইম্যাক্স]

সিনেমার ডিরেকশন,লোকেশন,সেট ডিজাইন, কস্টিউম আর প্রেজেন্টেশন আলাদা নজর কাড়বে।মনে হবে আপনি ১৯৭১ সালের সেই সময়টায় চলে গেছেন। সিনেমায় কমার্শিয়াল ইলিমেন্ট কম তবে গল্পের গম্ভীরতা আপনাকে ইমোশনালি কানেক্ট করবে। সিনেমার টেকনিক্যাল দিকগুলো যেমন : কালার, সিনেমাটোগ্রাফি,সাউন্ড কোয়ালিটি,বিজিএম ভালো ছিলো।আর গ্যালারির দর্শক ফেইক লাগেনি।

নেগেটিভ দিক : নাসির উদ্দিন খানকে ভালোভাবে ব্যাবহার করা হয়নি।শাহনাজ সুমির charecter এ কিছুই না রাখা।সিয়াম ও রাজের মিশনগুলোর এক ঝলক রাখা যেত।ফুটবল খেলার সিনগুলো এলোমেলো,এগুলোর দৃশ্যায়ন আরো ভালো হতে পারতো।বর্তমান নারী ফুটবলার টিমে একজন মেইন লিড নায়িকা’কে কাস্টিং করা উচিত ছিলো।তাহলে সে নিজেকে ফোকাসে রাখতে পারতো।আর দর্শক আরেকটু উপভোগ করতো।

দামাল একটি শিক্ষণীয় সিনেমা

আমাদের দেশ স্বাধীনে একটা ফুটবল টিমের হাত ছিলো এটা কয়জন জানতেন? বর্তমানে নারী ফুটবলার’দের কে নিয়ে আমরা কতই না কটুক্তি করি।এই সিনেমায় তাদের’কে দারুণভাবে এপ্রিশিয়েট করা হয়েছে।হয়তো এর মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটু পরিবর্তন হবে।রায়হান রাফি কে ধন্যবাদ আমাদের কাছে এতো সুন্দর কন্সেপ্ট এর একটি সিনেমা দেওয়ার জন্য।

ইমপ্রেস টেলিফিল্মের “দামাল” দেখেছি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মধুমিতা সিনেমাহলে।অন্যান্য সিঙ্গেল স্ক্রীন থেকে তুলনামূলকভাবে ভালোই পরিবেশ।সেই সাথে একটু ঠান্ডাই ছিল হলের ভিতরে কিন্তু সিনেমা শুরু হওয়ার সাথে সাথে হলরুম গরম হতে শুরু করে দর্শকদের ভিড়ে।সিঙ্গেল স্ক্রীনে যেমনটা হয় আর কি! একটু পর পর সিটি বাজানো,দর্শকের বাধভাঙ্গা উল্লাস হলরুম কে করে তোলে আরো প্রানবন্ত।আসলে এই জন্যেই সিঙ্গেল স্ক্রীনে ছবি দেখে একটু বেশিই আনন্দ পাওয়া যায়।

সিনেমা শুরুর বেশ কিছুক্ষন পরই হটাৎ উপস্থিত হন সিনেমাটির স্ট্রাইকার দূর্জয় চরিত্রে অভিনয় করা সিয়াম আহমেদ ও পরিচালক রায়হান রাফি।পুরোটা সিনেমা দর্শকের সাথে উপভোগ করেন এই অভিনেতা।আমি বারবার খেয়াল করছিলাম তার দিকে,সে পুরোটা সিনেমা খুব মনোযোগ দিয়েই দেখছিলেন।

সিনেমার বিরতিতে দর্শকের অনুরোধে বেশকিছু অটোগ্রাফও দিয়েছিলেন ভক্তদের।এই ব্যাপারটি একটু ভালোই লেগেছে আমার।একজন অভিনেতা নিজের ইগো,দাম্ভিকতা থেকে বেরিয়ে ভক্তদের সাথে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

এবার আসি মূল গল্পে

বাংলাদেশে এই প্রথম মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে নিয়ে কোন একটি সিনেমা হয়েছে।যা ফরিদুর রেজার ভাবনায় চিত্রনাট্য লিখেছেন যৌথভাবে নাজিম-উদ-দৌলা ও রায়হান রাফি এবং পরিচালনা করেছেন রায়হান রাফি।গল্পটি বাস্তবিক প্রেক্ষপটে ঘটে যাওয়া একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র।সিনেমাটি যখন দেখি তখন কিছু কিছু জায়গায় গা শিউরে উঠার মত চিত্র ছিল।বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ আর দেশ প্রেম সত্যিই মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।

মুন্না ও দূর্জয়ের ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা।সেই ভালোবাসা আগুনে সিক্ত হয় দেশকে স্বাধীন করতে।পাকিস্তানিরা দেশের মানুষকে শুষে খাওয়ার সাথে বাদ যায়নি ফুটবলের উপর থেকেও তাদের আগ্রাসন।প্রতিটি পদে বাঙ্গালীকে নিপীড়ন চালিয়েছে পাকিস্তানিরা।সেই তিক্ততা ছাপ পড়ে ফুটবলারদের উপরও।সেই জায়গা থেকেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের জন্ম।

সবার চরিত্রই সবাই ফুটিয়ে তুলেছিলন।তার মধ্যে বেশ কিছু চরিত্রের কথা না বললেই নয়।

সিয়াম আহমেদ : সিয়াম আহমেদ তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে অনেক গুলো চরিত্রে অভিনয় করেছেন।প্রতিটি চরিত্রেই তাকে ভিন্নতায় পাওয়া যায় এবং গল্পের সাথে মিশে যায় সে।এবারও তাকে ভিন্ন চরিত্রেই পাওয়া গেল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের স্ট্রাইকার “দূর্জয়” চরিত্রে।তার অভিনয় সত্যিই চোখে লেগে থাকার মত।সিনেমার শুরু থেকে পর্যন্ত পুরোটা সময় ধরে পাওয়া যাচ্ছিল সিয়াম কে।

তার অভিনয় দেখে একটুও বিরক্তিকর মনে হয়নি।দূর্জয় অগ্নিশিখার মতই জ্বলেছে,এই সিনেমায়ও।তার একটি সংলাপ খুবই ভালো লেগেছে “সবাই ডি বক্সের ভেতরে গেলে গোলপোস্ট দেখতে পায় কিন্তু আমি খালি লাশ দেখতে পাই,গোল কেমনে করমু?”। অসাধারণ ছিল ঐ সময়টা।

শরিফুল রাজ

শরিফুল রাজ চলচ্চিত্রে গুটি কয়েকটি সিনেমা করেছে কিন্তু দূর্দান্ত লেগেছে প্রতিটি চরিত্রেই।সর্বশেষ তার অভিনীত দুটি সিনেমাই ছিল ব্লকবাস্টার।এ সিনেমাতেও দারুণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।অধিনায়ক মুন্না হিসেবে তার সব সবটুকু ঢেলে দিয়ে প্রানবন্ত করেছেন চরিত্রটিকে।সেই সাথে রোমান্টিক দৃশ্য এবং যুদ্ধকালীন তার উপস্থিতি ভালোই উপভোগ করেছি।

সুমিত

সুমিতের ব্যপ্তিকাল শুরুতে না থাকলেও পরবর্তীতে হৃদয় স্পর্শ করেছে তার অভিনয়।সুমিত দামালে মুনির চরিত্রে অভিনয় করেছেন,যে ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গোলকিপার।গোলকিপার হিসেবে খুবই ভালো মানিয়েছে তাকে।একজন গোলকিপারের যা যা দিক থাকা দরকার,তার সবটুকুই পেয়েছি তার থেকে।এক্সপ্রেশন ছিল দূর্দান্ত।

মিম

মিম এর অভিনয় আগের থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে।হুমায়ুন আহমেদ এর পরিচালিত “আমার আছে জ্বল” সিনেমায় তাকে প্রথম দেখি।এরপর কেমন যেন হারিয়ে গিয়েছিল,পরবর্তীতে সাপলুডু তে তাকে ভালো অভিনয় করতে দেখা যায়।বর্তমানে খুব ভালো করছেন তিনি।এই সিনেমায় সে রাজ এর বউ হিসেবে নিজেকে ভালোই মানি নিয়েছেন।সেই সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে একজন দেশ প্রেমিক হিসেবে সেও যুদ্ধ করেছেন,তবে সেটা তার জায়গা থেকে।তাকে নিয়ে কিছু টুইস্ট আছে যেটা সিনেমাহলে গেলেই বুঝতে পারবেন।

শাহনাজ সুমি

শাহনাজ সুমি মেয়েটাকে প্রথম দেখি পাপপুণ্য সিনেমাতে।সেই সিনেমায় ভালোই অভিনয় করেছেন তিনি।সেবার তিনি সিয়ামের সাথে জুটি বেধে অভিনয় করেছিলেন এবার দামালেও তার ব্যতিক্রম নয়।মেয়েটা ভালো অভিনয় জানে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।সিয়াম-সুমি জুটির শেষ পরিণতি কি সেটাও জানতে হলে,যেতে হবে সিনেমাহলে।

সমু চৌধুরী

সমু চৌধুরী কে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।তিনি জাত অভিনেতা এটা সবারই জানা।দূর্জয়ের বাবা হিসেবে ভালোই মানিয়েছে তাকে।ছেলেকে ফুটবলে ভালো সাপোর্ট দিতেন সবসময়।

ইন্তেখাব দিনার

ইন্তেখাব দিনার দামালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।বলা চলে পুরো সিনেমাতেই ছিল তার ছড়াছড়ি।অভিনয় খুবই ভালো করেছেন তিনি।

নাছির উদ্দিন

নাছির উদ্দিন এর ব্যপ্তিকাল খুব কম ছিল।কিন্তু যতটুকু সময় ছিল প্রচুর আনন্দ পেয়েছি।সে সত্যিই একজন জাত অভিনেতা।

রাশেদ মামুনুর রহমান

রাশেদ মামুনুর রহমান কে এখন প্রায় সব ছবিতেই দেখা যায়।খুব ভালো অভিনয়ও করেন তিনি।এবারও দামালে তার ব্যতিক্রম ছিল না।দামালে তিনি শান্তি বাহিনীর “রাজাকার টুকু মিয়া” চরিত্রে অভিনয় করেন।অনেকটা সময় ধরে স্ক্রীনে দেখা যায় তাকে।ভালো ডায়লগ ডেলিভারি দিয়েছেন,সেই সাথে তার যাদুকরী এক্সপ্রেশন তো আছেই।

সাঈদ বাবু

সাঈদ বাবু রায়হান রাফির প্রথম ছবিতেও অভিনয় করেছিল পূজার ভাই হিসেবে।সেবার খুব প্রশংসাও পেয়েছিল।এবার দামালে সে পাকিস্তানি আর্মির “মেজর কামরান” চরিত্রে অভিনয় করেছেন।খুব সাবলীল ভাবেই উর্দুতে ডায়লগ ডেলিভারি দিয়েছেন।ভালো লেগেছে তার অভিনয়।তার ডায়লগের মধ্যে রাশেদ মামুনুর কে বলা “জিকজাক” কথাটা খুবই হাসিয়েছে।
এছাড়াও এই সিনেমাতে অভিনয় করেছেন সেতু আজাদ,সৈয়দ নাজমুস সাকিব সবাই সবার জায়গা থেকে ভালো করেছেন।এদের চরিত্র নিয়ে কিছু বলতে চাই না।এদের মধ্যে সৈয়দ নাজমুস সাকিব এর চরিত্রের ব্যপ্তিকাল খুবই ছোট ছিল কিন্তু সেতু আজাদ এর চরিত্র পুরোটা সময় গল্পের সাথে এগিয়েছে।এ সিনেমায় সেতু আজাদ একজন কমান্ডারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

রায়হান রাফি

রায়হান রাফি তার প্রথম সিনেমা দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন।তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা পোড়ামন ২ হয়েছিল ব্লকবাস্টার।সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন তিনি।তার প্রতিটি কাজেই কম-বেশি বাস্তবতার সাথে মিল রেখে কিংবা বাস্তব গল্প নিয়ে বানিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।বর্তমানে যে কয়েকজন পরিচালকের নামে সিনেমা চলে,তার মধ্যে রায়হান রাফি একজন।এটা অবশ্য তার কাজের মাধ্যমেই দর্শকের মন জয় করে নিয়েছেন।

সিনেমায় সিনেমেট্রোগ্রাফী,লোকেশন,ভিএফএক্স,গান,কালার গ্রেডিং,বিজিএম বাংলা সিনেমা হিসেবে আমার কাছে ভালো লেগেছে।আশা করছি চলচ্চিত্রের এই জনস্রোতে দামাল হাওয়া বয়ে যাবে প্রতিটি দর্শকের মনে। সবাই দামাল দেখুন দলেবলে! বেশি বেশি বাংলা সিনেমা দেখুন,বাংলা সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যান আরো বহুদূর।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *