‘হাওয়া’ মুভির শতকরা ৯৯% দৃশ্য সাগরের বুকে

গত ২৯ জুলাই, হাওয়া মুক্তির দিনে দেখেই কোন রকম স্পয়লার_ছাড়া , শুধুমাত্র ট্রেলার ডিটেলস থেকে এই বিশাল এক্সপ্লেনেশানটি লিখেছিলাম। সাম্প্রতিককালে OTT রিলিজের পর কিছু পশেরা পাইরেসি করে দেখে ঠিকমত বুঝতে পারছেন না #হাওয়া ‘র এত সুনাম কেন? তাদের জন্য পুনরায় লেখাটা দিচ্ছি। একবার মন দিয়ে পড়লেই হবে – সুন্দর বুঝে যাবেন সবকিছু।

যারা মুভিটি এখনো দেখেন নি, তারাও পড়তে পারেন। আমি রিভিউয়ের নামে গড়গড় করে মুভির কাহিনী বলে যাবো না। চেষ্টা করব একেবারেই স্পয়লার না দিয়ে মুভিটির ভাল-মন্দ ও ডিরেক্টরের ভিশনের সাথে দর্শক কতটা একাত্ম হলেন তা ব্যাখ্যা করতে।

ডিরেক্টর মেজবাউর রহমান সুমন আমাদের ট্রেলারে যা আভাস দিয়েছেন মুভিটি শুরু হয় তেমন করেই। চাঁন মাঝি তার জেলের দল নিয়ে মহাজনের স্টিমার ও জালসহ রওনা হয়েছেন বঙ্গোপসাগরে। মাঝিদের হাতে মোবাইল ফোন আভাস দেয় মুভির সময়কাল বর্তমান সময়েই।

মহাজনি নৌকা নিয়ে দরিয়ার বুকে মাছ ধরতে যাবার নিয়মটা খুব সাধারণ। ৮/১০ দিন সাগরের বুকে ঘুরে যত মাছ পাওয়া যায় তা নিয়ে মাঝির দল ফিরবে বন্দরে। মাছ বিক্রির পর মহাজন নিজের ভাগে লাভের বেশি টাকা রেখে বাকি টাকা দেবে প্রধান মাঝিকে। প্রধান মাঝি সেই টাকা থেকে তার দলকে কাজ অনুসারে ভাগ করে দেবেন। শ্রেণী বিভাজনের এই করাল গ্রাস যুগ যুগ ধরে শ্রমিক ও সামন্তকে ভাগ করে রেখেছে। তবে সময়ের সাথে সাথে সদা সরল এই শ্রমিকের দলও শিখে গেছে দুর্নীতি।

মাদক কারবারিদের সাথে মাছধরা নৌকা ও মাঝিরা ব্যবহৃত হয়

মাঝ সাগরেই অন্য মহাজনের কাছে কিছু মাছ বিক্রি করে সেই টাকা নিজেরা রেখে দেয় জেলেরা। এছাড়া কক্সবাজার অঞ্চলের মাদক কারবারিদের গোপন পরিবহন হিসেবেও এইসব মাছধরা নৌকা ও মাঝিরা ব্যবহৃত হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই মাঝ সাগরে এক প্রধান মাঝির আদেশে নৌকার সবাই ইচ্ছে না থাকলেও এসব কাজে জড়ায়। তবে এরমধ্যে যে বিদ্রোহ হয় না তা নয়। মাঝেসাঝে কেউ কেউ টাকার ভাগ নিয়ে প্রতিবাদ করে। সেই প্রতিবাদ ঠান্ডা করাও হয় বেশ সুন্দর করেই।

চঞ্চল চৌধুরী অভিনীত চাঁন মাঝির দলবলটিও এরকম বৈধ-অবৈধ কাজে নানাভাবে জড়িত। তবে এবার ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। এক ঝড়ের রাতে তাদের জালে উঠে আসে আস্ত এক নারী। প্রথমে তারা মেয়েটিকে মৃত ভাবলেও পরে জানা যায় সে জীবিত। মাঝ সাগরের বিপদ সংকুল পরিবেশে এমন একদল প্রায় বর্বর জেলের জালে উঠে আসা নারীটিকে নিয়ে সেই নৌকায় কি কি হয় তা নিয়েই বাকি সিনেমার গল্প আবর্তিত।

‘হাওয়া’ মুভির সবচেয়ে শক্তিশালী ও দুর্বল দিক হল এর অতি রিয়েলিজম এপ্রোচ এবং মিথোলজিক্যাল সিম্বলিক অংশগুলো। যারা বঙ্গোপসাগরে জেলেদের জনজীবনে জড়িত ভাষা, প্রচলিত বিশ্বাস বা কুসংস্কার, বাংলাদেশের পটভূমিতে এসব মাঝিদের সাধারণ ব্যাক স্টোরি সম্পর্কে আইডিয়া রাখেন তাদের কাছে ‘হাওয়া’ একটা মাস্টারপিস।

অন্যদিকে যাদের এসব ব্যাকস্টোরি সম্পর্কে আইডিয়া নেই তাদের কাছে এটা বিশাল একটা আন্ডার ডেভলাপমেন্ট। বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্সে যা ঘটলো এবং যেভাবে ঘটলো সেই ব্যাপারটা। ভয় নেই, আমি স্পয়লার দিব না। শুধু ব্যাক স্টোরি ও মিথ ব্যাখ্যা করবো, যা জানা থাকলে আপনার ‘হাওয়া’ দেখার এক্সপিরিয়েন্স আরো ঋদ্ধ হবে।

দরিয়ায় মাইয়া ছাওয়াল যাওন নাই

আপনারা যারা ‘ন ডরাই’ মুভিটি দেখেছেন তারা নিশ্চয় জানেন “দরিয়ায় মাইয়া ছাওয়াল যাওন নাই” এমন একটা প্রচলিত কুসংস্কার আছে কক্সবাজারের সাধারণ মানুষের মাঝে। কাছাকাছি সংস্কারের ছোঁয়া পাওয়া গেল এই মুভিতেও। “মাছ ধরা নৌকায় মেয়ে মানুষ থাকতে নেই” – জেলেদের মধ্যে এমন বিশ্বাস প্রচলিত হলেও; নৌকায় বাসকারি যাযাবর গোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত টিকে থাকা বেদে সম্প্রদায়ের আবার উল্টো রীতি।

বেদেরা তাদের মেয়ে-বউ-সাপ-মাছ সবকিছুকে নিয়ে একসাথেই নৌকায় বাস করে। যদিও জেলেরা নিজের নৌকায় মেয়ে উঠায় না- তবুও শরীরের কামনায় কখনো কখনো তারা বেদেদের নৌকায় হামলা করে। চাঁন মাঝির মত অনেক পুরানো মাঝি সাগরের বুকে এমন লুট-ডাকাতি করে। মহাজনেরা এসব জানলেও তাদের ইকো সিস্টেমে বাঁধা দেয় না। ‘হাওয়া’ মুভির ব্যাকড্রপে এই পটভূমিটা জানা থাকলে দর্শক অনেক কিছু বুঝতে পারবেন।

সাগরে মাছ ধরে জেলেরা জীবিকা নির্বাহ করে। অন্যদিকে সাগরের মাছেদের রক্ষার জন্য আছে মৎস্য দেবী। এই দেবীরা কুহকিনী হয়ে নানা রূপে জেলে নৌকায় উঠে। এই কুহকিনী জেলেদের জাল কেটে দেয়; মাছেদের নৌকা থেকে দূরে রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, আশেপাশের সব নৌকা সাগরের এক জায়গায় মাছ পাচ্ছে। কিন্তু নির্দিষ্ট একটি নৌকা মাছ পাচ্ছে না। তখন জেলেরা বিশ্বাস করে তাদের নৌকায় প্রেত উঠেছে।

বঙ্গোপসাগরের জেলে ও বেদে সম্প্রদায় নিয়ে এই দুটি প্রচলিত কাহিনী বা লোকমুখে চলা গল্প খুব বড় প্রভাব রেখেছে ‘হাওয়া’ মুভির গঠন বিন্যাশে। কিন্তু ডিরেক্টর ইচ্ছে করেই দর্শকদের মুখে তুলে গল্পটা খাইয়ে দেননি। ক্লাইম্যাক্স দেখে সেজন্য কিছু মানুষকে আমি হতাশ হতে দেখেছি।

হাওয়া মুভির মধ্য দিয়ে সূহ্মভাবে মানুষের ষড়রিপুকে তুলে ধরেছেন

গল্পকার ও পরিচালক ‘হাওয়া’ মুভির মধ্য দিয়ে সূহ্মভাবে মানুষের ষড়রিপুকে তুলে ধরেছেন। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য – মানুষের নেতিবাচক এই ৬টি রিপুর নানা ইঙ্গিত ও দৃশ্য পুরো হাওয়া মুভিজুড়ে বিদ্যমান। স্পয়লার হয়ে যাবে বলে দৃশ্য ধরে ধরে আলোচনা করছি না। তবে সচেতন শিক্ষিত দর্শক মুভি দেখার সময় বুঝে নিবেন।

২ ঘন্টা ১০ মিনিটের এই অনবদ্য সিনেমাটি বাংলাদেশীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটা ট্রেডমার্ক হয়ে থাকবে। সেই ১৯৯৩ সালে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ মুভির পর এই প্রথম বাংলাদেশের জেলে জীবন নিয়ে এমন অনন্য সুন্দর মুভি নির্মাণ হয়েছে। মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ মুভির শতকরা ৯৯% দৃশ্য সাগরের বুকে, নৌকার উপরে, পানির নিচে, সাগরে ডুবে ডুবে চিত্রায়িত হয়েছে। প্রতিটি অভিনেতা তাদের শারিরীক সামর্থের সবটুকু উজার করে দিয়েছেন পারফর্মেন্সে। তবে এই শারিরীক শক্তি খাটাতে গিয়ে কিছু কিছু ভাল অভিনয় শিল্পী নিজেদের অভিনয় দক্ষতা সবটুকু দেখাতে পারেন নি।

আরোও দেখুন>>> 

বিশেষত কয়েকটা দৃশ্যে নাজিফা তুষি ও শরিফুল রাজ রাতের বেলায় স্টিমারের ডেকের নিচে সাগরে গলা পর্যন্ত ডুবে ডুবে অভিনয় করেছেন। নাজিফা তুষি শাড়ি পড়া ছিলেন, রাজ লুঙ্গি পড়া। পানির ঢেউ ও কাপড় সামলে সংলাপের গভীরতা তেমন করে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি তারা। সংলাপের একই হাল হয়েছে যখনই রাতের সিকোয়েন্সে প্রচন্ড ঝড়ো বৃষ্টির মধ্যে অভিনেতারা কথা বলেছেন। আমি জানি বাস্তবতায় বৃষ্টির মধ্যে এবং পানিতে ডুবে স্পষ্ট করে কথা বলা যায় না।

কিন্তু সিনেমায় ডায়লগ তো জরুরী। ডাবিংয়ের সময়েও শব্দ গ্রাহকেরা এই ব্যাপারটা উহ্য রেখেছেন। হয়তো পরিচালক রিয়েলিজম রাখার জন্য এমনটা করেছেন কিন্তু ডায়লগ স্পষ্ট রাখা দরকার ছিল আমি মনে করি। এই মুভিতে চঞ্চল চৌধুরী, সোহেল মন্ডল, নাসের উদ্দিন, শরীফুল রাজ, সুমন আনোয়ারের মত বাঘা বাঘা অভিনেতাদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারফর্ম করেছেন নাজিফা তুষি। দিন দিন অভিনয়ে পারঙ্গমতা অর্জন করেছেন তিনি ।

হাওয়া মুভিতে নাজিফা তুষির পারফর্মেন্স বের করে এনেছেন

তবে ‘হাওয়া’ মুভিতে নাজিফা তুষির পারফর্মেন্স বের করে এনেছেন চিত্রগ্রাহক কামরুল হাসান খসরু। স্ক্রিপ্টের সিংহভাগ সময়ে তুষির কোন ডায়লগ ছিল না। সুতরাং তার চোখের চাহনি, ঠোঁটের ভঙ্গিমা, ভ্রুক্ষেপ, কোমড়ের বাঁক ইত্যাদিকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক ও পরিচালক।

বলা যায় ‘হাওয়া’ মুভি থেকে আমাদের শ্রেষ্ঠ পাওয়া এর সিনেমাটোগ্রাফি। মাঝ সাগরে দিশাহীন ভাসতে থাকা একটা স্টিমারকেও সিনেমার জীবন্ত চরিত্র বানিয়েছে এর ক্যামেরার কাজ। নোঙ্গরের শেকলের সাথে সাথে সাগরের বুকে ক্যামেরা ঢুকে যাওয়া; আমাদেরকেও বাতাস থেকে পানিতে ডুবিয়েছে। এমন ব্রেক থ্রু সত্যিই বাংলা সিনেমার টেকনিকেল এস্পেক্টে বড় সংযোজন।

সিজিআই বা ভিজুয়ায়ল গ্রাফিক্সেও বেশ নিপুণতা দেখিয়েছে ‘হাওয়া’। গভীর সাগরে নোঙ্গর ঘুরে আবর্তিত হওয়া মাছ বা দূরে নিঃশ্বাস ফেলা তিমি; ঝড়ে ভিজে কাবু হওয়া শালিক পাখি – কোনটাই সামান্য একটুও নকল মনে হয় নি। আমি দুঃখিত, ভিএফেক্স আর্টিস্টের নামটি বের করতে পারিনি। আপনারা কেউ জানলে কমেন্টে জানাবেন।

আরেকটা বিষয় হল- মুখের ভাষা। জেলেদের মুখ দিয়ে শ্রতিমধুর বাণী যে বেরুবে না তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু ‘তুমি বন্ধু সাদা পাখি’ গানের ভাইরালে ভেসে যারা বাচ্চাকাচ্চা সহ ‘হাওয়া’ দেখতে এসেছেন তারা বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন কিছু গালিগালাজময় দৃশ্যে।

ক্লাস ও মাসের মিশ্রনে সুস্বাদু একটা মুভি হাওয়া

আফসোস, চঞ্চল চৌধুরী এই পোড়ার দেশে জন্মালেন বলে বিশ্ব সিনেমা ইতিহাসে অমর হলেন না। কিন্তু যদি কোনভাবে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে চঞ্চল চৌধুরীর হাওয়া’র পারফর্মেন্সকে পৌঁছানো যায় কি যে খুশি হতাম। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুধুমাত্র দাঁত বের করে হাসি দিয়ে কিভাবে অন্তরাত্মা কাঁপানো যায় খুব ভাল করে দেখিয়েছেন তিনি। চিৎকার করে গলা ভেঙ্গে ফ্যাঁসফেঁসে কন্ঠে পুরোটা মুভি জুড়ে যেমন দাঁপিয়ে গেছেন তা সমীহ জাগানিয়া। বাকি অভিনেতাদের মধ্যে শুধুমাত্র নাসের খান তাঁর লেভেলে পারফর্ম করেছেন।

সবশেষে বলব মিউজিক নিয়ে। “সাদা পাখি কালা পাখি” নিয়ে আর কিছু বলার মত বাকি নেই। তবে বড় স্ক্রিনে যখন খেয়াল করেছি কোনরকম আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার ছাড়া’ কলসি, বাটি, চামড়া ও নৌকার খোল ইত্যাদির তালে গানটি রেকর্ড করা হয়েছে আবহকার ইমন চৌধুরীর উপরে সম্মান বেড়েছে। এছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর পুরো মুভির টোন ঠিক রাখতে খুব কাজে দিয়েছে।

যখন মুভিটা ঠিকমত শুরুও হয় নি; স্টিমার ছাড়া মাত্রই গোঙ্গানির মত করে সমস্বরে একদল নারী কন্ঠে “আইয়ো গো আইয়ো গো”বলে পিলে চমকে দিয়েছিলো। যাই হোক, সবলিমিয়ে আমার কাছে ‘হাওয়া’ একটা দৃষ্টান্ত স্থাপনকারি সিনেমা আমাদের জন্য। ‘মনপুরা’র মত একেবারে মাসি নয়; আবার ‘অজ্ঞাতনামা’র মত একেবারে ক্লাসি নয়। ক্লাস ও মাসের মিশ্রনে সুস্বাদু একটা মুভি ‘হাওয়া’। আশা করি কেউ পাইরেসি করবেন না। বৈধ পথে বাংলা সিনেমার পাশে থাকবেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *